Skip to content

Latest commit

 

History

History
60 lines (33 loc) · 15.5 KB

ইউটিউবের-গ্রামে-একদিন-সারফুদ্দিন-আহমেদ.md

File metadata and controls

60 lines (33 loc) · 15.5 KB


ইউটিউবের গ্রামে একদিন

সারফুদ্দিন আহমেদ



যে চরম গরম পড়েছে তাতে নিতান্ত গোবেচারা নরমসরম লোকেরও মাথা গরম হওয়ার কথা। ঘরের বাইরে পা ফেলামাত্র তাওয়া তাতানো তাপ ছ্যাঁৎ করে চামড়ার ওপর কামড় বসাচ্ছে। ঘাম বের হচ্ছে না, কিন্তু জান ‘বের হব হব’ করছে।

ভোঁ ভোঁ গরমে বাড়ি ফেরার সময় আচমকা লিটু মিয়ার নজরে এল পাটখেতের মাঝখানে বেশ খানিক জায়গার পাটগাছ কাঁপছে। খানিক বিরতি নিচ্ছে। তারপর আবার দুলছে। হেলে দুলছে। দুলে দুলছে। মাঝেমধ্য হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো খিঁচুনি দিয়ে কাঁপছে।

এই ঠা ঠা ঝিমমারা দুপুরে যখন আশপাশের একটা পাতাও নড়ছে না, ঠিক সেই মুহূর্তে পাটখেতের মাঝখানে কিছু পাটগাছ দাপাদাপি করছে। এই দাপাদাপিতে লিটু মিয়ার হৃদয়পুকুরে একটুখানি কাঁপাকাঁপি উঠল। ভিউ! বলে উঠল সে! এই তো সুযোগ। মোক্ষম দাও। ঝোপ বুঝেই কোপ মারতে হয়। পাটের ঝোপে সে এবার কোপ মারবে। হাতে আছে উপযুক্ত ইনস্ট্রুমেন্ট—স্মার্ট মোবাইল ফোন, উইথ তিন ক্যামেরা। লাইভ লাইভ। ফেসবুকে লাইভ করার এই মোক্ষম সুযোগ ছাড়ে কোন উজবুক।

‘আমি লিটু মিয়া, আমার ফেসবুক পেজ থেকে আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। দর্শকবিন্দু, এইখানে পাটখেতে সন্দেহজনক নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে।’

এই ডিজিটাল বাংলাদেশে স্মার্ট মানুষের ইয়ত্তা নেই, তারপরও লিটু মিয়াদের গ্রামটা ইউটিউবের গ্রাম বলে বিশ্বমানচিত্রে আপন যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছে। এই গ্রামে টিকিটিকির চেয়ে টিকটকার বেশি।

লাইভ জমে গেল। এক ভিউ, দশ ভিউ, হাজার ভিউ... লাইক, লাভ... হা হা! মনোপলি বিজনেস লিটু মিয়ার জমে উঠল ভালোই। কিন্তু বাঙালিমাত্রই হুজুগে। যুগটা হুজুগের, মোবাইল ফোন হাতে ইউটিউবার, ফেসবুকার আর টিকটকাররা ব্যাপারটাকে স্মার্ট জনসভায় উন্নীত করে ফেলল।

ডিজিটাল জনতা এখন পাটখেত ঘিরে রেখেছে। পাটগাছ নড়াচড়ার বিষয়ে একেকজন একেক ধরনের বিশেষজ্ঞ মত দিয়ে যাচ্ছে। সেসব রেকর্ড হচ্ছে, কারওটা প্রচারিত হচ্ছে লাইভে, কারওটা গ্রাম ছাড়িয়ে বিশ্বগ্রামে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইনস্টাগ্রাম।

গ্রামের সালিস করে বেড়ানোয় খুবই ওস্তাদ লোক তারা মিয়া। তিনি মুখ খুললেন। লিটু মিয়া মোবাইল হাতে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। পাটগাছগুলোর নড়নচড়নের ধরন দেখে তারা মিয়া আত্মহারা। বলে দিলেন, ‘কুনো সন্দো নাই, অসামাজিক আকাম–কুকাম চলতিছে।’ তাঁর কথায় উপস্থিত হাজেরানে মজলিশ, ‘ঠিক কথা, ঠিক কথা!’ বলে মাথা ওপর–নিচ করেছে। লাইভগুলোর ভিউ একলাফে শতক–হাজার ছাড়িয়ে সিক্স ডিজিটের দিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।

কঠিন গরমে রোজা রেখে টায়ার্ড হয়ে পড়া রিটায়ার্ড দারোগা সিরাজুল হক বললেন, ‘জিনিসটা এত হালকাভাবে নিয়ো না। পাটখেতের মধ্যি যে জঙ্গি–ফঙ্গিরা বোমাটোমা নিয়ে মিটিংয়ে বসে নাই, সে গ্যারান্টি তুমাগে দিচ্ছে কিডা?’

দারোগার কথায়ও সবাই ‘হুঁ, হুঁ, তা–ও হবার পারে!’ বলে গণসায় দিল।

জনা দশেক ফেসবুকারের লাইভ ধারাবর্ণনা মাঠখেতের নির্জনতাকে হট্টরোলের রূপ দিচ্ছে। মোবাইলের ক্যামেরা পাটখেতের মাঝখানে জুম করে তারা সোশ্যাল মিডিয়া গরম। গ্রীষ্মকালের গরম আরও সরগরম।

সরকারি দলের ইউনিয়ন সভাপতি হরমুজ পাটোয়ারী পাটখেতের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এর পেছনে বিরোধীদের নাশকতার চক্রান্ত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’ বিরোধী দলের সমর্থক হয়বাত আলী বললেন, ‘বিরোধী দলকে ফাঁসাতে সরকার নানা ধরনের ফাঁদ পাতে। এখানে সেই ধরনের গন্ধ পাচ্ছি।’

স্কুলশিক্ষক আফসার, যিনি সংগুপ্ত সজল নামে কবিতা লেখেন, বললেন, ‘ইদানীং এলাকায় ডাকাতি বেড়ে গেছে। হতি পারে বাইরে থেকে আসা ডাকাতরা পাটখেতে ঢুকে বসে আছে। রাত নামলিই কাজকর্মে নামবি। তাদের হাতে বন্দুকটন্দুক কী পরিমাণ আছে, তা-ও তো বোঝার উপায় নাই।’

পাটখেতের জনসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেওয়ার পর সাখাওয়াৎ হোসেন ওরফে ঠান্ডা মোল্লা বিকট চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কুন ভদ্দরলোকের ছাওয়াল–মাইয়া পাট ক্ষ্যাতের মদ্যি! জানে বাঁচতি চালি তাড়াতাড়ি বাইর হয়ে আসেক। না হলি কিন্তুক আমরা ভিতরে যাইয়ে ধরতি বাইধ্য হবানি।’

তবে পাটখেতের ভেতরে ঢোকার প্রস্তাবে কাউকে গা করতে দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডা মিয়াও হম্বিতম্বি করে ঠান্ডা হয়ে গেছে।

মুখে যতই ফটর–ফটর করুক, তারা কেউই পাটখেতের ভেতরে যেতে চাচ্ছে না। কারণ, লিটু মিয়ার পাটখেত কাঁপার ঘটনা আবিষ্কারের কিছু আগে নাকি ওদুদ চেয়ারম্যানের ছেলে আজিজকে এই এলাকায় দেখা গিয়েছিল। আজিজকে ভয় পায় না, এমন লোক কম। কারণ, আজিজের হাতে চড়–থাপ্পড় না খাওয়া লোকও এই এলাকায় কম। দশ–বারোজন চ্যালাব্যালা নিয়ে সে চলাচল করে। মাঝেমধ্যে লোকজনের মনে ভয় ধরানো আর নিজের অস্ত্রপাতির ফুটানি দেখানোর জন্য বাজারে গিয়ে সে লেদমেশিনের দেশি পাইপগানের গুলি ফুটায়। সে নাকি পাক্কা ডাকাত। মার্ডার–টার্ডারও নাকি করেছে।

এখন অপরাধী পাকড়াও করতে গিয়ে যদি দেখা যায়, সেখানে সত্যিই আজিজ, তাহলে চড় তো খাওয়াই লাগবে, কপাল খারাপ থাকলে গুলিটুলিও হজম করা লাগতে পারে। জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা থাকলে তারা কী করবে, তা কারও আন্দাজে আসছে না। সে কারণে পাটখেত অভিযানে এ চাচ্ছে সে যাক, সে চাচ্ছে ও যাক। ও ওকে ঠেলছে; সে তাকে ঠেলছে—ঠেলাঠেলি চলছেই।

বাদ জোহর ওদুদ চেয়ারম্যান এলেন। ভেতরে যে নিজের ছেলে আজিজ থাকতে পারে, সেই বিষয়টা প্রথমে ওয়াদুদ চেয়ারম্যানের মাথায় আসেনি। জ্বালাময়ী বক্তব্য শুরু করলেন তিনি, ‘দ্যাখো বাপুরা, আমার এলাকায় ক্রাইম-ট্রাইম সহ্য করব না। আমার নিজের ছেলে হলিও আমি মাফ করার পক্ষে না। আমি অর্ডার দিচ্ছি, তোমরা ভিতরে যাও। চোর, ডাকাত, লুচ্চা–বদমায়েশ যে-ই হোক, ধইরা–বাইন্ধ্যা নিয়া আসো। রামদা, সড়কি যা লাগে, নিয়া যাও।’

চেয়ারম্যানের কথায় আজিজ–বিষয়ক ভীতি কিছুটা কেটে গেলে ট্যারা মুহিত বলে ওঠে, ‘এইডাই চাচ্ছিলাম চেয়ারম্যান সাব। আপনে অর্ডার দিছেন। আপনার ডিউটি শ্যাষ। এইবার আমাগো ডিউটি। আমরা দ্যাখতেছি। এই মিয়ারা আসো তুমরা...!’

 ট্যারা মুহিত ওদুদ চেয়ারম্যানের লাঠি হিসেবে পরিচিত। একটা লাঠি হাতে নিয়ে সামনের পাটগাছগুলোকে দুই হাতে সরিয়ে বিলি কেটে এগোতে শুরু করল। অতি উৎসাহীদের কিছু বলতে হলো না। তারা রামদা, লাঠি-সোঁটা নিয়ে হা রে রে রে করে ঢুকে পড়ল।

দশ–বারোটা মোবাইল নিয়ে ফেসবুকার–ইউটিউবার–টিকটকার আর ইনস্টাগ্রামাররা তখন তক্কে তক্কে, লাইভ! লাইভ!

ট্যারা মুহিত শিকারিদের মতো পাটগাছ সরিয়ে ভেতরে যাচ্ছে। একটু ভেতর যেতেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গে অস্ফুট গোঙানি।

সবাই সতর্ক হয়ে উঠল। লোম খাড়া হয়ে গেল। সবাই একযোগে ‘ধর! ধর!’ বলে ছুটে গেল সেদিকে। মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেল মঞ্জিলে মকসুদে। কিন্তু একি! সামনে কালোমতো ওটা কী!

কাছে গিয়ে দেখা গেল, একটা বিরাট রামছাগল। গলায় দড়ি পেঁচিয়ে পড়ে আছে। অনেকগুলো পাটগাছ ভেঙে বৃত্তাকারে দক্ষযজ্ঞ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ আওয়াজ করার ক্ষমতাও তার নেই। জিহ্বা বের হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর সে পা ছুড়ছে। গোঙাচ্ছে।

লিটু দেখেই চিনতে পারল। ঈদের দিন জবাই করার জন্য সোলায়মান শেখ শখ করে রামছাগলটা কিনে এনেছে। সকাল থেকে গরুখোঁজা করেও সেটাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

ট্যারা মুহিত দৌড়ে কাছে গিয়ে গলার ফাঁসটা খুলে দিল। একজন ইউটিউবার ছাগলের মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতক্ষণ আইটকে ছেলেন, আপনার অনুভূতি কী!’ ছাগলটা আর্তনাদ মেশানো মুক্তির আনন্দভরা গলায় ডেকে উঠল, ‘ব্যাঁ...।’