Skip to content

Latest commit

 

History

History
74 lines (40 loc) · 11.5 KB

করোনাকালের-সংসার-সৈকত-শুভ্র-আইচ.md

File metadata and controls

74 lines (40 loc) · 11.5 KB


করোনাকালের সংসার

সৈকত শুভ্র আইচ



লকডাউনের প্রভাবে বউয়ের মেজাজ খানিক বিগড়ে গিয়ে ‘ন্যায্যতা, সমতা, শেয়ারড রেসপনসিবিলিটি’র মতো অসুবিধাজনক পদাবলি আওড়াতে থাকল। ঘাবড়ে গিয়ে সোফা-বালিশের কোল থেকে নিজেকে এবং নিজের কোল থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে সোজা হয়ে বসি। মুখে হাসি টেনে বলি—ওসব দারুণ দারুণ শব্দাবলি তো আমি সভা-সেমিনার-সেশনে প্রচুরই বলি; মানুষ বেশ প্রশংসাও করে। কিন্তু ওসব বাইরের কথা ঘরে কেন?

বউ দুয়ারজুড়ে দাঁড়িয়ে। যেন পালাবার পথ রোধ করে ফাঁদে ফেলা শিকার বধের আয়োজন!

দেখো, ‘হোম অফিস’ তো দুজনই করছি। বাসার একটা কাজেও তো হাত লাগাতে পারো। দিন-রাত সোফা-বালিশের স্তূপের মধ্যে ডুবে থেকে গ্লানি বোধ হয় না তোমার? মানুষ তো একটু নড়েচড়েও খায়, নাকি!

পৃথিবীতে যত কথা আছে, তার মধ্যে উচিত কথার চেয়ে খারাপ কথা বোধ হয় আর নেই। তাই উচিত কথা আমি কমই বলি, কিন্তু শুনি প্রচুর। সয়েও গেছে।

গৃহশান্তির স্বার্থে প্রতিটি কথায় সায় দিই। বাসার কাজগুলো করলে যে পরিমাণ ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ হয়, তাতে যে পরিমাণ ক্যালরি বার্ন হয় এবং তা যে এমন অবরুদ্ধ অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে কত জরুরি, তার সপক্ষে ‘বিবিসি হেলথ’-এর একটা আর্টিকেলের কিছু উদ্ধৃতিও দেই। নারী-পুরুষের সমানাধিকার, গৃহকাজে সম-অংশগ্রহণে সম্পর্কের উন্নতি ও সাংসারিক সমৃদ্ধির যত কিছু জানি, সবই একজন মোটিভেশনাল স্পিকারের মতো করে উপস্থাপন করি।

খুশি হলাম—বউ বলে। এবার বাসার কী কী কাজ আছে চলো তার তালিকা করি আর ফিফটি-ফিফটি ভাগ করি।

এমন একটা মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়ার পর এই প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। উৎকণ্ঠা গিলে বলি, চলো লিস্ট করি আর ভাগ করি।

কাজের তালিকা দেখি শেষ হওয়ার নয়! আমি আঁতকে উঠি। বাগানের গাছে জল দেয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, আসবাব মোছা, বাথরুম-বেসিন পরিষ্কার করা—ইত্যাকার তালিকার কিছু কাজ আমি বিভিন্ন ওজর-আপত্তি করে, আর কিছু কাজ আমার অপদার্থতা বিবেচনায় বউ নিজেই বাতিল করে দিলে আমি দিগন্তে মুক্তির দিশা দেখতে পেয়ে উল্লসিত হই। এভাবেই বাকি কাজগুলোও মেরেকেটে বেরিয়ে যেতে পারব বলে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে।

কিন্তু নিজের খ্যাতির জালে আটকে রান্নার প্রস্তাবটা এসকেপ করতে পারলাম না। বিশেষত বউ যখন বলে, তোমার রান্নার তো কত প্রশংসা! শখ করে রান্নাটাও তো করতে পারো।

আমার মতো প্রশংসাভুক প্রাণী কমই আছে। তাই এখানে ধরা খেলাম, বললাম, ওকে। কিন্তু কায়দা করে মনে করিয়ে দিলাম, ফিফটি-ফিফটি। তুমি এক বেলা, আমি এক বেলা।

হিসাব করে দেখলাম, সকালের নাশতাটায় চাপ কম। সেটারই দায়িত্ব নিলাম। বউ জুড়ে দিলে, যে বেলায় যে রাঁধবে না, সে বেলায় সে বাসন ধোবে। ডিল।

এ আর এমন কী ব্যাপার! বাড়ির সব কাজের ফিফটি পার্সেন্ট থেকে ফসকে কেবল একটা আইটেমের ফিফটি পার্সেন্টে সেটেল হওয়া তো বিরাট লাভজনক চুক্তি! আর খানিক আগের রণরঙ্গিনী তাতেই খুশি!

নিজের বুদ্ধিমত্তায় আপ্লুত হয়ে মুচকি হেসে, লকডাউনের অবসরে বেড়ে ওঠা গোঁফের কোনা মোচড়াতে মোচড়াতে কেরোনা বিস্তারের নিউজ আপডেট দেখতে লাগলাম। কিন্তু আমার পেছনে অদৃষ্টও যে মুচকি হেসেছিল, তা পরের দিন বাসন ধুতে যাওয়ার আগে আর টের পাইনি।

রাতে খাওয়ার পর শিডিউলড টাস্ক হিসেবে বাসন ধুতে গিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। বউ তো আমাকে ভীষণ ঠকিয়েছে! আমার সকালের নাশতার পর বউকে যে বাসনটুকু ধুতে হয়, তা বড়জোর একটা ফ্রাইপ্যান আর খান দুই প্লেট। আর এখন সিঙ্কের ওপর বাসন-কোসনের যে বহর, তা উচ্চতায় হিমালয়ের সমান না হলেও কেওক্রাডংয়ের চেয়ে কম নয়!

আমি আর্তনাদ করে বললাম, আশপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকেও বাসন-কোসন নিয়ে এসেছ নাকি আমাকে দিয়ে ধোয়ানোর জন্য?

ও রকমই মনে হয়—বেডরুম থেকে গলা চড়িয়ে বউয়ের উত্তর।

—আমি তোমাকে দিয়ে এতগুলো বাসন ধোয়াইনি।

—আমিও তোমাকে দিয়ে এতগুলো রান্না করাইনি।

—কাল থেকে তাহলে সকালের রান্না তোমার, রাতেরটা আমি করব।

—অসম্ভব। সকালের খাবার মুখে তুলতে না পারলেও দিনটা পার করতে পারব। কিন্তু রাতে কিছু পেটে না পড়লে ঘুম হবে না।

—হোয়াট!

বউ রান্নাঘরে ইনস্পেকশনে এল আমার শিডিউলড টাস্ক কেমন এনজয় করছি, বোধ হয় তা-ই দেখতে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে বুঝলাম আক্রমণাত্মক হয়ে লাভ নেই। তাই ’৯৬ বিশ্বকাপের মনোজ প্রভাকরের মতো ওভারের মাঝপথে পেস বলের বদলে স্পিন করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ফিসফিস করে বললাম, শোনো, আমার বোধহয় রাতে এখানে বাসন মাজাটা ঠিক হচ্ছে না।

—কেন?

—ওই যে পাশের বাড়ির জানালায় মহিলাটাকে দেখছে না!...

—তো?

—তোমাকে দেখামাত্রই কেবল টিভির দিকে মুখ ঘোরাল। এতক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল কেমন মায়া মায়া চোখে, যেন ভাবছিল আহা, আমার যদি এমন একটা স্বামী থাকত!

বউ ভ্রু কুঁচকে একবার জানালার দিকে, আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ভাবলাম এইবার কাজ হবে, এমন একটা মোক্ষম অস্ত্র ছুড়েছি!

৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এল। হাতে আমার একটা টি-শার্ট।

সেটা আমার মাথার ওপর দিয়ে গলায় নামিয়ে দিয়ে বলল, এখানে খালি গায়ে সিনেমা করছ কেন? টি-শার্ট পরে নাও।

কপাল! এতক্ষণ যা-ও গায়ে একটু বাতাস লাগছিল, এখন টি-শার্ট গায়ে ঘেমে-নেয়ে বাসন ধোয়া!

দুনিয়ার অবিচারে চোখ ভিজে এলে সান্ত্বনা নিতে পাশের জানালায় তাকাই।

মহিলা ততক্ষণে পর্দা টেনে দিয়েছেন।