Skip to content

Latest commit

 

History

History
38 lines (22 loc) · 10.6 KB

দুই-হোটেল-নিয়াজ-মেহেদী.md

File metadata and controls

38 lines (22 loc) · 10.6 KB


দুই হোটেল

নিয়াজ মেহেদী



সুলতানগঞ্জ বাজারে একটা কথা চালু আছে, ‘ভাই ভাই হোটেলে যে ভাত খায়নি, সে ভাতই খায়নি।’

কথাটায় বাড়াবাড়ি আছে কিন্তু একেবারে মিথ্যা নয়। সুলতানগঞ্জ সত্যিকারের সুলতান হলে ভাই ভাই হোটেল তার মাথার তাজ। খাবার খাইয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন কাজ। তিলে তিলে কাজটা করতে হয়েছে। অথচ আজ এক প্রচণ্ড ধাক্কায় ভাই ভাই হোটেলের এত দিনের ভিত কেঁপে উঠেছে।

আজমত আলী মোল্লার বিষয়টা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। ৪০ বছর ধরে তিনি ভাই ভাই হোটেলের গদি সামলাচ্ছেন। মিনিস্টার থেকে মিসকিন—সবাই তার হোটেলের ভাত খেয়েছে। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলা আর ১০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেওয়া তার বিজনেস সিক্রেট। বাইরে থেকে মনে হবে লোকটা ভীষণ নরমসরম। আসলে ভেতরে ভেতরে তিনি কঠিন হৃদয়ের পাষাণ। ব্যবসায়ী হতে হলে কঠিন হতেই হয়। এই বাজারে পয়সা করা বাঁ হাতের খেল নয়। বুদ্ধি থাকতে হয়। তবে তার চেয়ে দরকার কাঠিন্য। বড় গাছের ছায়া যেমন ছোট গাছকে বাড়তে দেয় না, তেমনি ভাই ভাই হোটেলের ত্রিসীমানায় তিনি কোনো হোটেলকে দাঁড়াতে দেননি। চেষ্টা অনেকে করেছে। কিন্তু আজমত মোল্লার কূটকৌশল আর হোটেলের হায়দার বাবুর্চির রান্নার সামনে কেউ টিকতে পারেনি। আজ বুঝি টিকে যায়!

কী পাওয়া যায় না ভাই ভাই হোটেলে? চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য—সবই এখানে পাওয়া যায়। প্রতিদিন ভর্তা হয় ৫০ রকম। জিবা স্বাদ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে যাবে কিন্তু খাবারের আইটেম শেষ হবে না। এখানকার গরুর মাংসের এতই খ্যাতি যে চট্টগ্রামের এক হুজুর দিওয়ানা হয়ে বাবুর্চিকে মেজবানে হায়ার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের মানুষ গরুর মাংস রান্নার ব্যাপারে হার স্বীকার করে না। কিন্তু এখানে এসে করতে বাধ্য হয়েছে।

আজমত আলী মোল্লা সাধারণত এমন আবদার রাখেন না। হোটেলের বাবুর্চিকে বাইরে কাজ করতে পাঠানো তার দুই চোখের বিষ। কী কুক্ষণে যে হায়দারকে যেতে দিয়েছিলেন, নিজেও জানেন না। তাতেই শুরু হয়েছে পতন। সাত দিনের ছুটি নিয়ে হায়দার চট্টগ্রামে থেকে এসেছে পাক্কা দুই মাস। শুধু তা–ই নয়, ওদিক থেকে মালকড়ি যা কামিয়েছে, তা দিয়ে ভাই ভাই হোটেলের ঠিক মুখোমুখি জনতা হোটেল খুলে বসেছে।

হায়দারের স্পর্ধা দেখে আজমতের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। এই হায়দার তার খেয়েছে, তার পরেছে, তারই বেতনভোগী হয়ে অতগুলো ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছে। লবণ নিয়ে হায়দারের কারবার, তাকে নিমকহারাম বলে গালি দিতেও আজমতের ঘেন্না হয়।

চট্টগ্রাম থেকে কীসব শুঁটকি-টুটকি রান্না শিখে এসেছে হায়দার। সুলতানগঞ্জে ওসব আইটেম কেউ কখনো খায়নি। এখন তোলপাড় করে খাচ্ছে। প্রতিদিন জনতা হোটেলে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে আর ভাই ভাই হোটেলের ভিড় কমছে। দেখেশুনে আজমতের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

হায়দার যাওয়ার পর আজমত একজন ভালো বাবুর্চি নিয়েছেন। লোকটার নাম শওকত। অনেক দিন ঢাকার এক হোটেলে রান্না করেছে। শওকত বেশ পরিশ্রমী। ভালোই রাঁধে, কিন্তু হায়দারের মতো জবরদস্ত হয় না। ফলাফল, ভাই ভাই হোটেলের শূন্য টেবিলগুলো শূন্যই রইল।

বেতাল হয়ে আজমত ডিসকাউন্ট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করলেন। তাতেও লোক এল না। ওদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়ার অজুহাতে হায়দার খাবারের দাম বাড়িয়ে দিল। আজমত মোল্লা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন, জনতা হোটেলের ভিড় আরও বেড়ে যাচ্ছে।

দিন দিন জনতা হোটেলের চেহারা বদলাতে লাগল। ঝকঝকে কেবিন, আধুনিক চেয়ার-টেবিল ও ক্রোকারিজের ব্যবস্থা করা হলো। রাস্তার এপাশ থেকে আজমত এসব দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তার ব্যবসার অবস্থা কাহিল। খাবার যা রান্না করা হয়, বেশির ভাগই পড়ে থেকে নষ্ট হয়। ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ায় হোটেলের লোকবল কমাতে হয়েছে। হোটেলের মেঝেতে ধুলার আস্তরণ জমেছে। রান্নাঘরে মাকড়সা জাল বুনেছে।

বেপরোয়া হয়ে আজমত বিভিন্ন ফিকির করেন। একবার ভাবেন গুন্ডা লাগিয়ে দিয়ে হায়দারের ঠ্যাং ভেঙে দেবেন, আরেকবার ভাবেন রাতের আঁধারে আগুন ধরিয়ে দেবেন ওর হোটেলে।

ভাবতে ভাবতে কোনো কিনারা করতে পারেন না। একদিন দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাশবাক্সে বসে আজমত হাই তুলছিলেন। এমন সময় রেইনকোটে ঢাকা একটা মূর্তি এসে হাজির হলো। আজমত অবাক হয়ে লক্ষ করলেন সেটা হায়দার। তার সাবেক বাবুর্চি। তার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। হায়দার কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ওস্তাদ, একটু লইট্টা শুঁটকি ভুনা করছি। ভাবলাম আপনের লগে চাইরটা ভাত খাই।’

প্লেট আনা হলো। দুজনে মিলে খেতে বসলেন। বাইরে অঝোরধারায় বৃষ্টি নেমেছে। জল-কাদার ভয়ে বাজারে একটা লোকও নেই। জনতা হোটেলের মালিক হায়দার ও ভাই ভাই হোটেলের আজমত একসঙ্গে বসে ভাত খাচ্ছেন। খেতে খেতে সুখে আজমতের চোখে পানি চলে এল। হায়দারের রান্না তিনি ৪০ বছর খেয়েছেন। মাঝে এই কিছুদিন খুব মিস করেছেন। চক্ষুলজ্জার কারণে গিয়ে খেতে পারেননি।

আজমতের চোখে পানি দেখে হায়দার বলল, ‘ঝাল লাগছে নাকি ওস্তাদ? ওই দিকে ঝালটা একটু বেশিই দেয়।’

আজমত মাথা নাড়লেন। তার শূন্য প্লেটে টপটপ করে ঝরে পড়ল একজন খাদ্যরসিকের অশ্রু।