Skip to content

Latest commit

 

History

History
36 lines (21 loc) · 20.7 KB

বুঙ্গাশিকারি-ওয়াসি-আহমেদ.md

File metadata and controls

36 lines (21 loc) · 20.7 KB


বুঙ্গাশিকারি

ওয়াসি আহমেদ



লোকটার নাম যে হাশর, এ নিয়ে মাহমুদ হাসানের মনে সামান্যতম সন্দেহ তো নেই–ই, এত বছর পরও তার দড়িপাকানো কিন্তু শক্তপোক্ত শরীর, নাকের ডগায় গোলমরিচের মতো তিলটাকে পর্যন্ত মনে করতে পারছেন। অথচ গ্রামের লোক এ নামে কাউকে চেনে না; বরং তিনি নাম ভুল করছেন, ভুল হওয়া স্বাভাবিক, হাজার চেনা-জানা মানুষের নাম নিয়ে গন্ডগোল পাকানোও কোনো ব্যাপার না—এমন যথার্থ যুক্তি দাঁড় করাতে যখন সবাই মোটামুটি একমত, তখন তার মনে হলো, লোকটা যদি মরেও গিয়ে থাকে, মরা লোকটাকে কেউ মনে রাখবে না! হতে পারে, তার ছেলে-মেয়ে ছিল না, এমনকি ভাই-বোনও না। কিন্তু জ্ঞাতিগোষ্ঠী তো ছিল, তারা? মাঝারি আয়তনের একটা গ্রাম, আর তিনি তো সেই গ্রামে বসেই তার খোঁজ করছেন। আত্মীয়স্বজন যার যার মতো চেষ্টা করেছেন, করারই কথা। এত বছর পর তিনি দেশে ফিরেছেন, মাত্র দুই দিন ঢাকায় কাটিয়ে গ্রামে এসেছেন, আর এসেই হাশর বলে যাকে খুঁজছেন, সে নামে জীবিত বা মৃত কারও খবর তাদের জানা নেই।

খুঁজছেনই-বা কেন? দীর্ঘদিন দেশছাড়া হলেও তিনি নামীদামি মানুষ। অনেকে যারা তার সম্বন্ধে জানত না, বিশেষ করে অল্প বয়সীরা, তারাও এর-ওর মুখে জানতে পারল, তিনি বিদেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার ওপর সরকারের খেতাব পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা। ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লেগেছিল, পা-টা সারেনি, কেটে বাদ দিতে হয়েছিল, তবে নকল পায়ে দিব্যি হাঁটাচলা করেন। নকল পা-টা দেখতে কেমন, কীসের তৈরি, কী করে কাটা পায়ের সঙ্গে জুড়তে হয়—এ নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল থাকলেও তাকে তো নকল পা দেখাতে বলা যায় না, বা সেটা পরার কায়দা নিয়েও প্রশ্ন করা চলে না। মানী লোক, এলাকার গণ্যমান্যরা খবর পেয়ে দেখা করে গেছেন, এ ছাড়া চেনা-অচেনা লোকজনেরও তাকে নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। একটা গণসংবর্ধনা দেওয়ার কথাবার্তা চলছে। এলাকার এমপি নিজে তোড়জোড় করে নেমেছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি যখন তারই হওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা বাধাচ্ছে হাশর। ভাবসাবে মনে হচ্ছে, হাশরকে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি অন্য কিছুতে মন দিতে নারাজ। তিনি যে বিশ বছরের ওপর দেশছাড়া, এই লম্বা সময়ে দেশে যে এত পরিবর্তন ঘটে গেছে—এসব নিয়ে তার মধ্যে আগ্রহ-কৌতূহল দেখা যাচ্ছে না। যা দাঁড়াচ্ছে—আগে হাশর, পরে অন্য কিছু।

মাহমুদ হাসানের হতাশ লাগে। এলাকার মানুষজন যাদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই, তারা যে একটা মুশকিলে পড়ে গেছে, তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। এ–ও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তাদের কেউ কেউ বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তার কী করার আছে? তিনি কী করে বোঝাবেন, বিশ বছর পর তার দেশে আসার কারণ একনজর হাশর নামে ছোটখাটো গড়নের মানুষটার দেখা পাওয়া। মন বলছে, হাশর বেঁচে আছে। এমন ভাবার অবশ্য কারণ নেই। বয়সে হাশর তার থেকে কম করে হলেও আট-নয় বছরে বড়। তার নিজের সত্তর ছুঁই ছুঁই, সে হিসাবে আশি বা আশির কাছাকাছি বয়সের একজনের বেঁচে থাকা নিয়ে মন যা-ই বলুক, ভরসা করা চলে না। তারপরও দুরুদুরু আশা জীবিত হাশরের দেখা পাওয়া।

এসব কথা কাকে বোঝাবেন? লোকজন খোঁজাখুঁজি করে জানিয়ে দিয়েছে, এ নামে কেউ নেই, ছিলও না। তিনি নামে ভুল করছেন; হতে পারে হাশেম, হাতেম বা হারান। তারা এমনও বলেছে, তিনি যেন ভেবেচিন্তে অন্য নাম বলেন।

অন্য নাম মাহমুদ হাসান কোথায় পাবেন? হাশর তো হাশরই, দুনিয়া উল্টে গেলেও হাশরের নাম পাল্টে ফেলার মতো জালিয়াতি তিনি কল্পনা করতে পারেন না।

এ অবস্থায় তাকে ধীরেসুস্থে এগোতে হলো। ভেবেচিন্তেই, তবে লোকজন যেমন ভেবেছিল, সে রকম নয়। তিনি জানালেন, আমেরিকার ক্লিভল্যান্ড নামের যে ছোট শহরে তিনি থাকেন (বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, এ তথ্য জানানো জরুরি মনে করলেন না), সেখান থেকে হঠাৎ দেশে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তার শারীরিক অবস্থায় আসার কথাও নয়। বাইরে থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে–ভেতরে একটা বড়সড় অসুখ তাকে কাবু করতে উঠেপড়ে লেগেছে। দুটো কিডনিই প্রায় অচল, তারও পর ক্যানসার নামের রোগটার নষ্টামির খবর তো সবার জানা, সেই ক্যানসারও অনেক দিন পিছু নিতে নিতে আর সময় দিতে নারাজ।

অসুখ-বিসুখের সঙ্গে হাশর নামের লোকটার কী সম্পর্ক, এ নিয়ে লোকজনের ধন্দ টিকিয়ে রেখে বললেন, হাশরকে যদি একবার পেতেন। আরও বললেন, এটা বড় আশ্চর্যের, হাশরের মতো লোককে গ্রামে কেউ চেনে না। তিনি হাশরের চেহারার বা শারীরিক বর্ণনা দিতে গেলেন না, পঞ্চাশ বছর আগে একটা লোক দেখতে কেমন ছিল, সে স্মৃতি তার মাথায় যতই জ্বলজ্বল করুক, এত দিন পর অন্যদের কাছে সে বর্ণনা অর্থহীন। তবে কেউই যখন কিছু বলতে পারছে না, তখন লোকটার ব্যাপারে কিছু তথ্য দেওয়া যেতেই পারে। তিনি জানালেন, হাশর ছিল এ গ্রামেরই লোক, ঘরামির কাজ জানত, ডাক পেলে মন দিয়ে কাজ সারত। সেই সঙ্গে বাড়তি রোজগারের লোভে গোপনে অন্য একটা কাজও করত। একসময় সেটাই হয়ে উঠেছিল তার মূল কাজ। কাজটা ছিল ঘোরতর বেআইনি—চুরি-ডাকাতির মতোই বেআইনি। এতটুকু বলে তিনি রহস্য ঝেড়ে বললেন, হাশর তাকে পার করে দিয়েছিল। শুধু তাকে না, ছোট ছোট দল নিয়ে আরও অনেককে পার করেছিল, রাতের পর রাত শুধু পারাপারই করে গেছে। অচেনা পথঘাটে রাতভর ছুটে ছুটে পথ দেখিয়ে কতজনকে যে নিয়ে গেছে, সে হিসাব কে রেখেছে! সে নিজে যে রাখেনি তিনি নিশ্চিত। রাখার তার দরকারই-বা কী! কাজটা তো কেউ তাকে করতে বলেনি, সে নিজে নিজেই দায়িত্বটা নিয়েছিল। সেই লোকটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো হদিস পর্যন্ত মিলছে না, এ তার নিজের দুর্ভাগ্য ছাড়া কী!

যারা শুনছিল তারা কী বুঝবে মাথামুণ্ডুহীন কথা থেকে! পার করার ব্যাপারটাই তাদের ধাঁধায় ফেলল। এ পর্যায়ে মাহমুদ হাসান দুঃখিত গলায় বললেন, তিনি বেশি না, পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছেন। পঞ্চাশ বছর মোটেও বড় সময় না, হাজার বছরের ঘটনা মানুষের মাথায় থেকে যায়। আপনারা হাশরকে ভুলে গেলেন! বললাম, না, সে যা করত তা বেআইনি, এপার থেকে চাঙাড়ি ভরে খাসিয়া পান, সুপারি, ট্রিট ব্লেড, তিব্বত স্নো নিয়ে ওপারে যেত, আর টেন্ডুপাতার বিড়ি, জবাকুসুম তেল, বরোলিন এবং আরও কীসব নিয়ে এপারে ফিরত। ওই কাজটা করত বলেই তার সুবিধা হতো পারাপারে, গোপন পথঘাট তার মতো কে চিনত যে সারা রাত আঘাটা-কুঘাটা পাড়ি দিয়ে পথ চিনিয়ে ভোর-ভোর কলকলিহাট ক্যাম্পে পৌঁছে দেবে!

এত দূর শুনে লোকজন এ–ওর মুখে তাকাল। এত প্যাঁচ না কষে তিনি সাফ-সিধা বুঙ্গাশিকারি বললেই পারতেন। আসার পর থেকে হাশর হাশর করছেন। গ্রামে বুঙ্গার কারবারি একজনই। বয়স্করা কেউ কেউ মনে করতে পারল, এককালে তার নাম সম্ভবত হাশর বা হাসু—এ রকম কিছু ছিল, কিন্তু বুঙ্গার কারবার যে করে তার আবার নাম! হাশর না বলে তিনি যদি গোড়াতেই লোকটার পরিচয় দিয়ে এসব বলতেন, কাজটা কত সহজ হতো! তবে তিনি যা বললেন, তা বেশ আচানক শোনাল। সেই পঞ্চাশ বছর আগে যুদ্ধের সময় সে তার কাজ-কারবার ছেড়ে এলাকার ও আশপাশের ছেলে-ছোকরাদের নিজ গরজে ওপারে করিমগঞ্জের কলকলিহাট মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে নিয়ে যেত, এ খবর তাদের অজানা। তবে ঘটনা সত্যি না হয়ে যায় না। এত বড় মানুষ মাহমুদ হাসান পঞ্চাশ বছর আগের কথা মনে করেই না গ্রামে অর্থাৎ দেশে ফিরেছেন। দেশ বলতে বুঝি তার কাছে শুধুই এক বুঙ্গাশিকারি! এদিকে তিনি যে ভাবছেন, লোকটা বেঁচে আছে—এ–ও কম আশ্চর্যের না। হ্যাঁ, বেঁচে আছে, তবে কিছুদিন হলো সে তার ভিটি বিক্রি করে মাইল তিনেক ভাটিতে কুড়া গাঙের পাড়ে কাউয়াটিকিতে এক ভাইপোর সঙ্গে থাকছে। বয়স আশি পার হওয়ার কথা, চোখে ভালো দেখতে পায় না, কানেও গন্ডগোল, শুয়ে-বসে দিন কাটায়। ভাইপো নাকি ভালোই দেখভাল করে। শোনা কথা, ভিটি বেচে ভাইপোকে টাকা দিয়েছে মাছের কারবারে লাগাতে।

মাহমুদ হাসান যখন হতাশা নিয়ে হাশর সম্বন্ধে কথা বলছিলেন, তিনি ভাবতে পারেননি, ফলাফলটা এত চটজলদি পেয়ে যাবেন। বড় কথা—হাশর জীবিত। কুড়া বা বুড়া—যে গাঙের পাড়েই থাকুক, যেতে তাকে কে আটকাবে! চোখ-কান ভালো কাজ করে না, তাতে কী! তাকে যদি চিনতে না পারে, তাতেই-বা কী! নিজেকে তার চেনানোর দরকার আছে? তবে একটা ক্ষীণ, টিমটিমে আশা—যদি পারে, চিনতে।

বুঙ্গাশিকারি! মানুষের দেওয়া নাম—খেতাব বললেও অসুবিধা কোথায়? খেতাবের চাপে নামটা হারিয়ে গেছে। মাহমুদ হাসান খেতাব পেয়েছিলেন খোদ সরকারের কাছ থেকে, খেতাবটা নামকে চাপা দিতে পারেনি। এখন আরেক খেতাবধারীর সামনে দাঁড়িয়ে বা পাশে বসে নিজের খেতাব নিয়ে না তিনি বেকায়দায় পড়েন! খেতাবটা তো জুটেছিল হাশরের কারণে, রাতভর টিলা-টক্কর, বন-জঙ্গলের পথে হাঁটিয়ে ভোরের আলো ফোটার মুখে তাকে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছিল, আর পষ্ট মনে আছে বিদায় মুহূর্তে শার্টের পকেটে পাঁচ টাকার একটা নোট গুঁজে মলিন হেসে বলেছিল, বুঙ্গার টেকা।

রাতে শুতে গিয়ে মাহমুদ হাসানের মাথায় পঞ্চাশ বছর আগের অকল্পনীয় একটা রাত নাছোড় হানা দেয়। সে রাতে হাশরের পিছু পিছু ক্লান্তিহীন ছুটে ছুটে তার মনে হয়েছিল, এই লোকটা কি মানুষ? হাশরের হাঁটার ধরন ছিল নিঃশব্দ, তবে অসম্ভব দ্রুত, ছেঁড়া জোছনায় ঘাসের ওপর, ঝোপঝাড়ের শিশিরের ওপর তার পিছলকাটা দুরন্ত ছায়া ছুঁতে গিয়ে তিনি না ভেবে পারেননি এ কে, কার পিছু ছুটছেন?

সূর্য উঠবে-উঠবে এমন সময় একটা ছোট হাটমতো জায়গায় সুপারিগাছের ফালি-ফালি বেঞ্চে বসতে ইঙ্গিত করে হাশর মুখ খুলেছিল—তারা পৌঁছে গেছে। চ্যাপ্টা কাচের গেলাসে তার হাতে হাশর চা ধরিয়ে দিয়েছিল, সঙ্গে লম্বাটে খটখটে বনরুটি। হাশরের দেখাদেখি গুড়-চায়ে বনরুটি ভিজিয়ে চিবোতে চিবোতে রাতের ঘোর কাটিয়ে তিনি চোখ খুলে হাশরকে দেখছিলেন। চেহারায় ক্লান্তি ছিল, তবে নাকের ডগায় গোলমরিচটা দিনের প্রথম আলোয় চকচক করছিল।

আগামীকাল সেই দেখার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভাবতে তিনি শিউরে উঠলেন। ঘরের ভেতরে ঘনঘোর অন্ধকারে পরিষ্কার মনে হচ্ছে পা দুটো তার বেজায় চঞ্চল, কাটা পা-টাও অন্য পায়ের সঙ্গে জোড় বেঁধে, যেন পাল্লা দিয়ে চাঙা হয়ে উঠেছে। যেন দুটো পা-ই জানে সামনে দুস্তর, দীর্ঘ পথ—বন-জঙ্গলময় এবড়োখেবড়ো পথহীন পথ, ছেঁড়া জোছনায় ঝোপঝাড়ে, শিশিরভেজা ঘাসে একটা পিছলকাটা দুরন্ত ছায়া। ছায়াটাকে ছোঁয়া চাই, দুটো পা-কে তালে তালে ঝোড়ো বেগে ছুটতে হবে। দুই পা-ই রাজি।