Skip to content

Latest commit

 

History

History
52 lines (29 loc) · 11.7 KB

বোনেদের-বাড়ি-উম্মে-ফারহানা.md

File metadata and controls

52 lines (29 loc) · 11.7 KB


বোনেদের বাড়ি

উম্মে ফারহানা



‘তুমি স্বর্ণা না? বিদ্যাময়ী স্কুলে মর্নিং শিফটে ছিলা না?’ নতুন বাজার মোড়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ করেই পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল সালোয়ার–কামিজ পরা এক মহিলা। একটা মুহূর্ত লাগল তাকে চিনতে, স্কুলের ক্লাসমেট ময়না। মফিজউদ্দিন স্যারের মেয়ে।

প্রায় জোর করেই তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল ময়না। রিকশায় বাউন্ডারি রোড হয়ে কোন কোন গলি পার হয়ে পৌঁছাল, খুব ভালো চিনলাম না। আমি শহরে থাকি না প্রায় ২০ বছর হয়। এখন চারদিকে এত উঁচু উঁচু দালান, আমার স্মৃতির সঙ্গে কিছুই মেলে না। একটা গলির সামনে রিকশা থামল, সরু গলি, রিকশা ঢুকবে না। কাদাজল থেকে স্যান্ডেলটা বাঁচিয়ে কোনোমতে হেঁটে গেলাম। টিনের একটা বাড়ি, সামনে একচিলতে জায়গায় সন্ধ্যামালতীর ঝাড়। গলিটা হয়তো পরে উঁচু হয়েছে, তাই সামনের কয়েক হাত জায়গায় বৃষ্টির পানি জমা, তাতে একটু বাদে বাদে কয়েক জোড়া ইট ফেলে রাখা। 

ঘরে ঢুকলাম। প্রথম ঘরটাতে বড় টেবিলের পাশে বেঞ্চ পাতা, স্যার মনে হয় এখানেই ছাত্র পড়াতেন। স্যারের ইন্তেকালের খবর কার কাছে শুনেছিলাম এখন আর মনে নেই। 

স্কুলে ময়না ভর্তি হয়েছিল ক্লাস এইটে, অনেক দিন একসঙ্গে পড়লে যেমন বন্ধুত্ব হয়, ময়নার সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব আমার হয়নি। সে বিদ্যাময়ীতে ভর্তি হয়েছিল অনেক দেরিতে। মফিজউদ্দিন স্যার যে স্কুলে পড়াতেন সেই অখ্যাত স্কুলেই সে ছিল। তারপর নাকি বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিদ্যাময়ীতে চলে আসে।

ময়না আমাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। মশারির স্ট্যান্ডওয়ালা দুই খাট দুই দিকে, মাঝখানে দেয়াল ঘেঁষে স্টিলের আলমারি। বৃষ্টির দিন বলেই মনে হয় আধভেজা কাপড় মশারির স্ট্যান্ডে মেলে দেওয়া, পুরোনো সিলিং ফ্যান ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে। আমি একটা সালোয়ার একটু সরিয়ে খাটের একপাশে বসলাম। 

ময়না বলল, ‘পা তুইলা আরাম কইরা বসো, আমি চা বানায়া আনতেছি।’ মোবাইল ফোন খুলে ডেটা অন করলাম আমি, চা বানাতে যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণ বসে মেইল চেক করে ফেলা যায়। এদের বাসায় ওয়াই–ফাই আছে বলে মনে হলো না। 

এক বাটি মুড়ি–চানাচুর আমার সামনে রেখে পা তুলে খাটে বসল ময়না। মনে হয় অন্য কেউ চা বানিয়ে আনবে। 

‘এই বাসায় কে কে থাকে?’ আমি আসলে ময়নার বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানি না। আর্লি ফরটিজে এসে বাবার বাড়িতে কেন থাকে, সেটা সরাসরি জিজ্ঞেস তো করা যায় না। 

‘আমি থাকি। আমার ছোট দুই বোন থাকে—চন্দনা আর পাপিয়া। চন্দনা তো বিদ্যাময়ীতেই পড়ত, আমাদের দুই ক্লাস নিচে। আর পাপিয়া আমার ছয় বছরের ছোট, সে-ও পরে বিদ্যাময়ীতে ভর্তি হইছিল।’ 

‘কিন্তু তুমি যে একবার বলছিলা, স্যার তোমারেই বিদ্যাময়ীতে দিতে চান নাই, ওদের সময় রাজি হইছিলেন?’ 

‘ওহ, তত দিনে তো আব্বার ওই ইস্কুলের চাকরিটা চইলা গেছিল, আমরা বোনেরা তো ভালো ছাত্রী ছিলাম, আব্বা ভাবছিলেন আমরা ইস্কুল থাইকা এসএসসিতে ভালো ফল করলে ইস্কুলের নাম হবে। কিন্তু আব্বার ইস্কুলের জন্য যত দরদ ছিল, ইস্কুলের আব্বার জন্য অত দরদ ছিল না।’

আমি চুপ করে অপেক্ষা করলাম, স্যারের স্কুলের চাকরিটা কেন চলে গিয়েছিল, সেটা হয়তো ময়না নিজেই বলবে। আমি আরেক মুঠি মুড়ি নিয়ে চিবাতে থাকি। 

‘আব্বা তো বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। একবার পনেরোই আগস্টে ক্লাসে পোলাপানরে জিজ্ঞেস করছিলেন, বল দেখি আজকে কী দিন? পোলাপান পারে নাই। তখন আব্বা নাকি বলছিলেন আজকে জাতির পিতার মৃত্যুদিন, তোরা এইটা জানস না?’

মফিজউদ্দিন স্যার ইংরেজি পড়াতেন। ভালো পড়ানোর জন্য নাম ছিল। অন্য অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরাও তার বাসায় এসে প্রাইভেট পড়ত। কিন্তু ইংরেজি ক্লাসে স্যার এই প্রশ্ন করবেন কেন? 

ময়না আমার মুখ দেখেই মনে জাগা প্রশ্নটা মনে হয় বুঝতে পারল। বলল, ‘আব্বা তো খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন, সেই দিন মনে হয় ওনার মন খারাপ ছিল বেশি, তা না হইলে গ্রামার ক্লাসে এই সব কথা তোলার দরকার কী। তখন তো দেশে কেউ শেখ মুজিবের নামই উচ্চারণ করে না। বেসরকারি স্কুল ছিল তো, স্কুলের কমিটি আব্বাকে শোকজ করে। ব্যাপারটা সামাল দেওয়া খুব কঠিন ছিল না, কিন্তু আব্বা চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করেন নাই। শোকজ লেটারের জবাব দেন নাই আবার রেজিগনেশন লেটারও দেন নাই। প্রিন্সিপালের কোন ভাইগ্নারে চাকরি দেওয়ার দরকার পড়ছিল, তাই এই ইস্যুতে আব্বার চাকরি খায়া দেওয়া হইলো, এই আরকি।’

চন্দনা একটা ট্রেতে পানি আর চা নিয়ে এসে খাটে রাখল। ময়না বলল, ‘পাপিয়া বাসায় নাই রে? একটু ডাক দে, আমার বান্ধবীর লগে দেখা করুক।’ 

‘ছোট আপা টিউশনিতে গেছে।’ ছোট করে জবাব দিল চন্দনা। 

ময়না আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা বোনেরা এখন সবাই মাস্টারিই করি। আমি ফিজিকস পড়াই, চন্দনা কেমিস্ট্রি আর পাপিয়া পড়ায় ইংরেজি, আব্বার সাবজেক্ট। আমাদের বাড়িটা নিয়া একটা মামলা চলতেছে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে। খরচ অনেক, তাই পাপিয়া বাড়তি টিউশনি নিছে।’ 

ময়নার বড় ভাই রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল, স্কুলে পড়ার সময়। আমার মনে পড়ল, আমরা গাঙ্গিনারপাড়ে মানববন্ধন করেছিলাম তখন।

‘ভাই না থাকলে বাপের সম্পত্তির বেশ খানিকটা অংশ চাচাতো ভাইরা পায়া যায়, জানো নিশ্চয়ই। ভাইয়া মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে আম্মাও স্ট্রোক করলেন। আব্বা আমাদের নামে বাড়ি লিখ্যা দিতে চাইছিলেন, কিন্তু সময় পান নাই। হঠাৎ কইরাই হার্ট অ্যাটাক হয় দুই বছর আগে। আমাদের চাচাতো ভাইদের আবার পলিটিক্যাল পাওয়ার অনেক। তারা বাড়িটা দখল করতে চায়। মামলায় আমরা জিতব কি না জানি না। তবু চেষ্টা করতেছি আরকি।’

চা শেষ করে আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসি। চন্দনা গেট খুলে দিয়ে বলে, ‘আপা, আবার আইসেন।’ 

ওর হাসি দেখে মনে হয় যেন তাদের বাড়ি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা নেই।