Skip to content

Latest commit

 

History

History
80 lines (43 loc) · 20.6 KB

হন্ত্রক-এনামুল-রেজা.md

File metadata and controls

80 lines (43 loc) · 20.6 KB


হন্ত্রক

এনামুল রেজা



মায়ানগরে হন্ত্রকেরা ফিরে এসেছে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি বিষয়টা, তার চেয়ে বেশি গুছিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিশ্চল পড়ে থাকা ছেলেটি অস্ফুট শব্দ করে উঠল। ও কি পানি চাইছে?

বইপত্রে হন্ত্রকদের কথা সামান্যই পাওয়া যায়। অতিবয়স্কদের কেউ কেউ ঝাপসাভাবে মনে করতে পারেন। আত্মহত্যার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল যুদ্ধপরবর্তী সেই বছরে। বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারী-পুরুষেরা ছিলেন এদের প্রধান শিকার। তখন পৃথিবীতে মানুষের চলাচল ছিল সীমিত। ছিল কানকথার অন্যতম যুগ। তিল সহজেই হয়ে যেত তাল। রেডিওর বার্তা আর দৈনিক পত্রিকা ছাড়া তথ্য সংগ্রহের তেমন উপায় মানুষের ছিল না।

কিন্তু আজ এত বছর পর সবকিছু বদলে গেছে। মানুষ স্বেচ্ছায় একে অন্যের হাঁড়ির ভেতর কী আছে, তা সবাইকে দেখাতে ও দেখতে ভালোবাসে—গোপনীয়তা বলে কারও জীবনে কিছু অবশিষ্ট নেই। মায়ানগরে হন্ত্রকদের পুনরাবির্ভাব তাই একটা চাপা কৌতূহল ছাড়া আর কিছুরই জন্ম দিতে পারল না প্রথমটায়।

তবে কৌতূহল ত্রাসে বদলে যেতে খুব বেশি সময় নেয়নি। অল্প কয়েক দিনের ভেতরই পরপর সাতজন মধ্যবয়সী পুরুষ আত্মহত্যা করলেন নগরের বিভিন্ন প্রান্তে। মৃতদের কেউ ফলের ব্যবসায়ী, কেউ উবার চালক, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ ব্যাংকের কর্মকর্তা বা আমলা। লোকজন নড়েচড়ে বসল যখন সোশ্যাল মিডিয়ার লাইভে এসে এক সাবেক মন্ত্রী নিজের মাথায় গুলি করে আছড়ে পড়লেন স্ক্রিনের ওপরই।

তার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন এই রকম ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলল। প্রথমে হত্যাকাণ্ড বলে অনেকের মনে হলেও ধীরে ধীরে প্রকট হয়েছে যে এগুলো আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এ ছাড়া দুর্ঘটনাগুলোর কোনো প্যাটার্নও নেই। কেউ ছয়তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে নিচে, কেউ ব্লেড দিয়ে হাত কেটে মরেছে রক্তক্ষরণে, কয়েকজনকে পাওয়া গেছে যারা বিষ খেয়েছে বা ছুরি দিয়ে ফাঁক করে দিয়েছে নিজেদের গলা। শুধু একটা দিক দিয়েই এ আত্মহননের মহামারিকে সন্দেহ করা যায়—ঘটনাগুলো ঘটেছে অন্যদের চোখের আড়ালে, এমন কোনো সময় যখন ভিকটিমের আশপাশে আর কেউ ছিল না। মানুষগুলো কেন এমন করছে, তার চেয়ে বেশি সবাই আতঙ্কে ডুবে যাচ্ছে তাদের কথা ভেবে যারা এমনটা করাচ্ছে সবাইকে দিয়ে।

এই হন্ত্রক আসলে কারা? কী তাদের উদ্দেশ্য? তাদের ছায়া মাড়ালেই কেন শহরের লোকজন আত্মহননের জ্বরে ভোগে?

খুব বেশি তথ্য কারও কাছে নেই। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাটা এমন—দশ–বারোজনের একটা দল ওরা। মানুষের মতোই দেখতে। খুব স্নিগ্ধ, সৌম্য। পরিচ্ছন্ন পোশাক–আশাক। শিকারের জন্য ওরা ওত পেতে থাকে না। বরং কাছে চলে আসে শিকারের নিঃসঙ্গ মুহূর্তে।

হয়তো গভীর রাতে কেউ ফাঁকা বাসে ফিরছে ঘরে। হন্ত্রকের দল তখন এসে লোকটার চারপাশে বসবে। নরম কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করবে। কতক্ষণ, এর ঠিক নেই। এসব বর্ণনা পাওয়া যায় ওই ফাঁকা বাসে ওঠা নতুন কোনো যাত্রীর মুখে। সে বাসে ওঠার সময় দেখে, দশ–বারোজন লাইন ধরে নেমে যাচ্ছে। কন্ডাক্টর বা ড্রাইভার কিছু বলছে না। হন্ত্রকদের শিকার হয়েছে যে লোক, সে নাকি বোবা হয়ে যায়, মানে তার মৃত্যুর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং লোকটা আত্মহত্যা করে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই।

কিন্তু এই অহরহ ভিডিও ধারণের যুগে কেউই কি ওদের একটা ফুটেজ ধারণ করে রাখতে পারেনি? না। তা পারেনি। হন্ত্রকেরা নাকি সম্মোহন জানে, এমনকি কারও কারও ধারণা, শিকার করার সময় চারপাশের সব ঘটনা তারা স্থির করে দিতে পারে। সে কারণেই হয়তো আতঙ্কটা শহরের বুকে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। সন্ধ্যায় নিজের চিরচেনা ফ্ল্যাটেও একা বসে থাকতে ভয় পাচ্ছে মানুষ। রাতে একা হাঁটতে গেলেও একটা চাপা দুশ্চিন্তার মেঘ থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না তারা। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ভেসে উঠছে আত্মহননে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া মানুষদের নাম। টিভি চ্যানেলে যেসব সুন্দরী মেয়ে খবর পড়ে, তাদের প্রায় সবার চোখের নিচেই কালি জমেছে। অন্যের মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করার ভার কি নিজের মৃত্যু আশঙ্কার চেয়ে ভারী হতে পারে?

এসব ঘটনার মধ্যেই আমার দিন কেটে যাচ্ছিল।

নিজেকে ঠিক স্বাভাবিক মানুষ আমি মনে করি না। এ পর্যন্ত দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। প্রথমবার কীটনাশক খেয়ে। মরে যাওয়ার বদলে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছিলাম। হাসপাতাল থেকে তিন দিন পর সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি নিতে চেষ্টা করেছিলাম। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ ছিল না মায়ানগরে। আমি ঝুলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ ফিরেছিল। ঘুরতে থাকা ফ্যানের দড়ি ছিঁড়ে দেয়ালে আছড়ে পড়লাম। মাথায় ভয়ানক জখম হলো। এরপর থেকেই কেন জানি না, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা খুব বেড়ে গেল।

কিন্তু তত দিনে হন্ত্রকদের মনে মনে কামনা করা হয়ে গেছে আমার। অফিসের বৃদ্ধ দারোয়ানের মুখে শুনেছিলাম, নিজেদের পছন্দমতো শিকার করতে ভালোবাসে ওরা, সবার কাছে আসে না। তবে কেউ ডাকলে ওরা আসবেই।

আমরা মায়ানগরের মানুষেরা আজকাল আর হাসি না। মানে হাসার কথা সম্ভবত আমরা ভুলে গিয়েছি। অফিসে যাই, কাজ করি নিঃশব্দে। বুঝে নিই যে আমাদের খুব বেশি একা থাকা যাবে না। কারণ, নিঃসঙ্গ মানুষেরাই হন্ত্রকদের আকর্ষণ করে বেশি। কিন্তু অনেক বছর ধরে আমরা এই পৃথিবীতে একলা চলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছিলাম। নিঃসঙ্গতার একেকজন সম্রাট আমরা। হুট করে চাইলেও একে অন্যের খুব কাছে যাওয়া আমাদের পক্ষে তাই অসম্ভব। তবু একদিন রিসিপশনের মেয়েটিকে বলেছিলাম, ‘তুবা, আজ সন্ধ্যায় কি আপনার তাড়া আছে? যদি না থাকে, চলেন একসঙ্গে ডিনার করি।’

তুবা রাজি হলো সামান্য মাথা নেড়ে। অফিস শেষ হওয়ার কিছু আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

তখনো বিকেলের রোদের কিছু নিস্তেজ আভা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে শহরজুড়ে। আকাশ লালাভ, দেখলে কেমন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হয়। রাস্তায় অনেক মানুষ। তাদের চোখেমুখে ঘরে ফিরে যাওয়ার তাড়া।

মিরপুর আড়াই নম্বরে সেকেলে ধরনের একটা ফুডকোর্টের নিচে আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার। ওপরে ওঠার সময় ঘর্ঘর শব্দ করতে লাগল লিফট। ফ্যাকাশে আলোয় লিফটের আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম আমরা। তুবা মিষ্টি করে হাসল। আমার মনে হলো, এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, অথচ ওর থেকে আমার দূরত্ব হয়তো ৯ কোটি আলোকবর্ষ।

দূরত্বের এই বিষণ্নতা ছাপিয়ে যে কথা আজকাল আমরা সহজে মনে করতে চাই না, সে কথাই বারবার মনে হতে লাগল। আচমকা যদি কোনো ফ্লোরে লিফট থামিয়ে উঠে আসে হন্ত্রকের দল!

ফুডকোর্টের অধিকাংশ দোকানেরই শাটার টেনে দিয়েছিল। লোকজন তেমন নেই। টেবিলগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। সরাসরি এসির হাওয়া গায়ে লাগবে না—সে রকম একটা টেবিলে বসেছিলাম আমরা। তুবাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘কী অবস্থা দেখেন! মাস ছয়েক আগেও এ সময় এখানে বসার জায়গা পাওয়া যেত না!’

তুবা হাসল। বললাম, ‘কী খাবেন?’

যেকোনো কিছু।

কালো চাঁদার বারবিকিউতে আপত্তি আছে?

নাহ্​। এখানে পাওয়া যায় নাকি?

যায়। পমফ্রেটস নামে আমার পরিচিত একটা দোকান আছে এখানে। একেবারে কোনার দিকে। ওই দেখেন ধোঁয়া উড়ছে। মাছের আইটেমের জন্য বিখ্যাত।

অর্ডার দেওয়ার জন্য উঠলাম আমি। কাছাকাছি কোথাও থেকে মসলা আর পোড়া মাছের সুস্বাদু ঘ্রাণ এল নাকে। ধোঁয়ার ফাঁকে দেখলাম, কাউন্টারের সামনে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টারের ছেলেটার সঙ্গে কিছু নিয়ে ওদের বাগ্​বিতণ্ডা হচ্ছে। আগবাড়িয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই ভেবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ফুডকোর্টের ছাদ স্বচ্ছ কাচে মোড়া। কাচের ওপাশে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার। একটাও তারা নেই।

অবশেষে অপেক্ষা ফুরাল। লোকগুলো চলে যাচ্ছে। একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মিষ্টি করে হাসল। কাউন্টারের পরিচিত ছেলেটার নাম পনির। আমাকে দেখে পনির কিছুই বলল না। কালো চাঁদার বারবিউকিউ হবে কি না, জানতে চাইলাম। জবাবে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পনিরের চোখ দুটো ভাষাহীন।

ব্যাপারটা বুঝে উঠতে সময় লাগল না আর। এই যে আমার সামনে বোবা দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি, ওর আয়ু খুব অল্প। এ মুহূর্ত থেকে তিন দিনের মধ্যে নিজেকে শেষ করবে ও। ফিসফিসে একটা কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠলাম ভয় পেয়ে। নিঃশব্দে তুবা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘এই প্রথম আক্রান্ত কাউকে দেখলাম। আপনি এত কাছে থেকেও কিছু করতে পারলেন না, তা–ই না?’

আপনি কীভাবে বুঝলেন?

মনে হলো ছেলেটাকে দেখেই। জানেন, আজকাল আর সেভাবে ভয়ও করে না আমার!

মরতে ভয় করে না?

তুবা জবাব দিল না। কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে এলাম আমরা। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়েছিল মেয়েটা। বাসা কাছেই ওর। লিফট দিতে চাইলাম, রাজি হলো না। অনেকক্ষণ ধরে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে রাতেই পনিরকে আমি বাসায় নিয়ে আসি। ফোন করে অফিস থেকে ছুটি নিই তিন দিনের। ছুটি পেতে এই যুগে আমাদের কারও কোনো যন্ত্রণা হয় না। চাওয়ামাত্রই মিলে যায়।

গত দুই দিন এক মুহূর্তের জন্যও পনিরকে চোখের আড়াল করিনি আমি। দুইবার বারান্দা থেকে ও লাফ দিয়ে পড়তে চেয়েছে। একবার মাথা ঠুকেছে টয়লেটের বেসিনে। ভাগ্য ভালো যে সেলাই লাগেনি। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি যত্ন করে। তারপর শক্ত করে বেঁধে রেখেছি আমার বিছানার সঙ্গে, যাতে উঠে যেতে না পারে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ও। মাঝেমধ্যে শুধু গোঙানির মতো শব্দ করে। আমার মনে হয় যে পানি পিপাসায় অমন করে পনির।

তিন দিনের মধ্যে আত্মহত্যা করতে না পারলে কি বেঁচে যাবে ও? আমি জানি না। কিন্তু শিকার সময়মতো না পেলে হন্ত্রকেরা কী করবে?

যত না পনিরকে আমি বাঁচাতে চাই, তার চেয়ে বেশি একধরনের জেদ এসে ভর করে বুকে। হন্ত্রকেরা এই অসুখী পৃথিবীর একাকী মানুষদের কী বলে আত্মহননের মন্ত্রণা দেয়, জানতে ইচ্ছা করে আমার।

তৃতীয় দিনের সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটের দরজার ওপাশে অনেকগুলো ভারী পায়ের শব্দ এসে থামে। মানুষের পায়ের শব্দ এমন মায়াবী তবলার মতো বাজে না কখনো।