হাওড়া স্টেশনে ঢুকেই বড় ঘড়িটার দিকে চোখ যায় সাবিরের। যাঃ! রাত দশটা বেজে গেল! অফিস থেকে ফ্ল্যাটে ফেরাটাই কাল হল তবে। সোজা চলে এলে কখন পৌঁছে যেত সে দেশের বাড়ি। তবে উপায়ও তো ছিল না। কিছু খেয়ে আসতেই হত। নইলে অত রাতে পৌঁছে খাবে কী? যত রাত্রেই হোক না কেন, যে মানুষটাকে ফোন করে সে পৌঁছেছে আর গরম ভাতে ঘি রেডি পেয়েছে, তিনি আজ তিন বছর হল অতীত। শুধু একটা ফোন করতে হত, ‘‘মা, আসছি আজ।’’ বউ মারুফা তাই পইপই করে বলেছিল, রাতে কিছু খেয়ে বেরতে হবে। তার গ্রাম এখন আধা-শহরে পরিণত হয়েছে। লাস্ট ট্রেন পর্যন্ত স্টেশনে টোটো অন্তত থাকবেই। আর এই শেষ-অক্টোবরে এখনও তেমন শীত নেই যে সব বন্ধ হয়ে যাবে সাত তাড়াতাড়ি।
হাওড়া স্টেশন যেন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা আজ। কিছু দিন হল নিয়মিত গ্রামে যেতে হচ্ছে সাবিরকে। তিন ভাইবোনের অনেক আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে ঠিক হয়েছে, তিন কাঠার উপর তাদের একতলা বাড়িটা বেচেই দেওয়া হবে। দুই আপার প্রথমে আপত্তি ছিল। কিন্তু বড় দুলাভাইয়ের বাইপাস সার্জারিতে অনেক খরচের পর বড় আপা রাজি হলে ছোটও আর আপত্তি করেনি।
বাড়ির টান কি আর সাবিরের নেই! কিন্তু বয়স বাড়ছে। ছেলে রামিজ এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। জয়েন্টে বসবে। তার জন্য কোচিং-এ ভাল টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে রোশনিরও ক্লাস নাইন হয়ে গেল। তা ছাড়া তাদের বাগান-পুকুর সহ নিজস্ব কবরস্থান তো আর বিক্রি হচ্ছে না। গ্রামের ভিতরে আছে ওদের পুরনো বাড়ি, যাকে ওরা বলে ‘ওবাড়ি’। সেখানে এখন থাকেন বাকি দুই চাচা। সেই বাড়িতেই ওদের তিন ভাইবোনের জন্ম। সাবিরের যখন ছয়-সাত বছর বয়স তখন তার আব্বা এই বাড়িটা করেন, গ্রামের বাইরের দিকে জমি কিনে। আব্বা ছিলেন পাশের শহরের স্কুলের ইংরেজির টিচার। হাসিখুশি পরোপকারী সেলিম মাস্টারের নামে আজও মানুষ মাথা নোয়ায়। বাড়িটা বিক্রি হলেও আত্মীয়দের মধ্যেই থাকছে, এটাও স্বস্তি। সাবিরের চাচাতো বোনের সেই দেওর পাশের শহরে শোরুম খুলেছে। শহর বাড়তে বাড়তে তাদের গ্রাম ছুঁয়েছে। বম্বে রোড সিক্স-লেন হওয়ায় তাদের গ্রামের জমির দাম চড়চড় করে বাড়ছে। সব ভেবেচিন্তে সাবির-মারুফার যুক্তিতে সায় দিয়েছে আপারা। একদম সমান সমান তিন ভাগ। আগামীকাল উকিলের সঙ্গে কথা বলে সব ফাইনাল করে রেজিস্ট্রির দিন ঠিক করে আসবে।
হাওড়া স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডগুলো সব আজ ফাঁকা। কি মুশকিল! কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে সাবির! সে জানে, দশটা না দশটা-পনেরো নাগাদ একটা মেচেদা লোকাল আছে। তাদের স্টেশন পৌঁছতে বড়জোর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট। মোটামুটি সোয়া এগারোটা নাগাদ বাড়ি ঢুকে যাবে। দশ দিন আগেই গিয়েছিল সাবির, তাই বাড়ি পরিষ্কারই আছে। হয়তো কাল সকালে গেলেও হত, কিন্তু সকালে এক বার ফাইনাল মাপ হবে বাড়ি আর জমিটার। তার চেয়েও বড় কথা, আজ সাবিরের বাড়িটায় একা থাকার ইচ্ছে হল খুব। কত স্মৃতি! আব্বা আর মায়ের খুনসুটি। মায়ের রান্নার গন্ধ। আব্বার পড়ার কাঠের চেয়ার-টেবিল। হ্যারিকেনের হালকা আলোয় মায়ের হাতপাখার হাওয়া খেতে খেতে ঘুমে ঢলে পড়া। গরমকালে ছাদে মাদুর বিছিয়ে আব্বার সঙ্গে আকাশ দেখা, তারা চেনা।
“আচ্ছা দাদা, মেচেদা লোকাল কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দেবে?” কাউকে না পেয়ে সাবির জিজ্ঞেস করে টুপি আর সাদা জামা পরা লোকটাকে। টুপিতে তার মুখটা ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না।
“ষোলো নম্বর। ওই যে ওই দিকে।” লোকটা হাত নেড়ে ইশারা করে দ্রুত এগিয়ে যায়।
ষোলো নম্বর! পনেরো নম্বরের পরে আরও বেড়েছে নাকি! সাউথ-ইস্টার্নে পনেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দিলে সবার হৃৎকম্প শুরু হয়। ষোলো নম্বর প্ল্যাটফর্ম কি তারও পরে! দ্রুত হাঁটতে থাকে সাবির। হঠাৎ চোখে পড়ে, সামনেই লেখা ষোলো নম্বর। কিন্তু এ প্ল্যাটফর্মের আলোটা বড্ড ঘোলাটে। লোকজন-দোকানপাট কিচ্ছু নেই।
ট্রেনে এক জন জানালার ধারে বসেছিল। “মেচেদা লোকাল?” জিজ্ঞেস করে সাবির।
“হ্যাঁ,” ছোট্ট জবাব আসে।
উঠে পড়ে সাবির। কামরায় লোক খুব কম। সবাই চুপচাপ। সাবিরেরও তেমন কথা বলার ইচ্ছে কই। ট্রেন ছাড়তেই চোখ বুজে স্মৃতিতে ডুব দেয় সে। তিন ভাইবোনকে নিয়ে পড়াতে বসেছেন সেলিম মাস্টার। আব্বার কাছে পড়া, সে এক মজার ব্যাপার ছিল। ইংরেজি দিয়ে শুরু হত, পরে তাতে ইতিহাস-ভূগোল থেকে নানা গল্প, তামাশা, খিলখিল হাসি, সব মিশে যেত। মা কখনও কপট রাগ করতেন, আবার রান্না ঘর থেকে ফোড়নও কাটতেন মাঝে মাঝে।
“হর্নস অব এ ডিলেমা মানে কী বল তো?”
“জানি না আব্বা। তুমি বলো।”
“মানে হল উভয় সংকট। শোন তবে, এক বার গ্রামে এক নতুন মাস্টার এসেছে, ইংরেজির। ছাত্রছাত্রীরা সব তার কাছে ইংরেজি শিখতে ছুটল। পুরনো ইংরেজির মাস্টার গেল খেপে। বলল, ‘নতুন মাস্টার কিচ্ছু ইংরেজি জানে না। দু’জনের সামনাসামনি পরীক্ষা নেওয়া হলেই বোঝা যাবে কার কত বিদ্যে।’ গাঁয়ের সবাই রাজি হল। একটা মাঠের মাঝে দুই মাস্টার এসে দাঁড়াল। চারপাশে গ্রামের লোক। ঠিক হল দু’জনে দু’জনকে ইংরেজি ধরবে। উত্তরটা চেঁচিয়ে সবাইকে বলতে হবে। পুরনো মাস্টার বলল, ‘আগে আমি ধরব।’ তাই হোক। ‘বলো তো, ‘হর্নস অব এ ডিলেমা’ মানে কী?’ নতুন মাস্টারের জানত উত্তরটা। এ বার পালা নতুন মাস্টারের। সে আস্তে করে বলল, ‘আচ্ছা বলুন তো আই ডোন্ট নো মানে কী?’ পুরনো মাস্টার চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি জানি না।’ ব্যস। মাস্টার জানে না, জানে না। হেরে গেল সে!”
হাসি শুরু হয়ে গেল ভাইবোনদের। আড়াল থেকে ফুট কাটেন মা, “বুঝলি তো, তোদের আব্বা হল সেই বোকা মাস্টার।” আব্বা বললেন, “হ্যাঁ আমিই সেই। বোকা না হলে তোমায় বিয়ে করি!”
শৈশবের দিনগুলো মনে করে চোখের কোণ ভিজে যায় সাবিরের। সাবির স্টেশনে নেমে দেখল আজ বড্ড ফাঁকা। একটাও টোটো নেই। তখনই কে যেন পিছন থেকে ডাক দিল।
“ও সেলিম মাস্টারের ব্যাটা, বাড়ি যাবে তো?” পিছনে তাকিয়ে দেখে, তাদের গ্রামের হারুকাকা। বহু দিন পরে দেখল হারুকাকাকে।
“কেমন আছ কাকা?”
“চলছে বাপ। ওটো দিকিনি।” কেমন যেন তাড়া হারুকাকার আজ।
“কাকা দিঘির ধারে নামিয়ে দিও। ইট-রাস্তায় যেতে কষ্ট হবে তোমার।”
“আমার কুনো কষ্ট হবেনি। তবে তুমি যখন বলছ...”
দিঘির পাড়ে নামে সাবির। সামনের মোড় ঘুরলেই তার বাড়ি দেখা যাবে। হাঁটা লাগায়। মোড় থেকে বাঁয়ে ঘোরে। কিন্তু এ কী! তাদের বাড়িতে আলো জ্বলছে কেন? চাবি তো শুধু তার কাছে! দুশ্চিন্তা মাথায় ভিড় করে। কী করবে ভাবতে ভাবতে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ ভিতরের দরজা খুলে যায়। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে তার মা।
“কী হল, দাঁড়ালি কেন? আয়।”
মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ঘরে ঢোকে সাবির।
“বাথরুমে বালতিতে পানি, সাবান, তোয়ালে, সব আছে। হাতমুখ ধুয়ে নে বাবা। অনেক রাত হল। খেতে আয়। ও হ্যাঁ, ও ঘরে তোর আব্বা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে।”
“আব্বা! কী বলছ! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আমি আসব তোমরা জানতে?”
“দেখো ছেলের কথা! ছোটবেলায় ইস্কুল থেকে এলে তোর গেট খোলার আগেই দরজা খুলে দিতাম না? তুই বলতিস, ম্যাজিক জানো না কি মা!”
টলতে টলতে পাশের ঘরে ঢোকে সাবির। সেই কাঠের চেয়ারটায় বসে আছে আব্বা।
“এসেছ? বোসো। অবাক হচ্ছ তাই না?”
“আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে আব্বা! তোমরা...”
“মৃত! তাই তো? হ্যাঁ পৃথিবীতে আমরা মৃত। কিন্তু পৃথিবীর পরেও যে পৃথিবী আছে সেখানে আমরা পুনরুজ্জীবিত।”
“কী করে সম্ভব আব্বা?”
“দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অর আর্থ, হোরাশিয়ো, দ্যান আর ড্রিমট অব ইন ইয়োর ফিলসফি... জানো তো?”
“জানি। হ্যামলেট।”
“তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। জীবন মানে হল শক্তি। আর শক্তি অবিনশ্বর। মৃত্যুর পর সেই শক্তি কোথায় যায়? সে আর এক পৃথিবীতে নতুন আকার পেতে পারে না কি!”
“কিন্তু আমি এ পৃথিবীতে এলাম কী করে?”
“চেয়েছ তাই এসেছ। চাওনি আমাদের দেখতে, কাছে পেতে, ছুঁতে!”
“খুব চেয়েছি আব্বা। কিন্তু চাইলেই কি পাওয়া যায়! আর তোমরা? তোমরা আমাদের কাছে পেতে চাও না?”
“এ পৃথিবীতে এসে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব সব শেষ বাবা। তবে হ্যাঁ, তোমরা ভাল আছ, সুখে আছ, বুঝে সন্তুষ্টি আছে। আর এখানে চাইলেই তো আর আসা যায় না। তুমি সৌভাগ্যবান।”
“কিন্তু...”
“আর কিন্তু না। যা মুখহাত ধুয়ে খেতে বস। মা বসে আছে।”
খেতে বসে সাবির। মা সামনে বসে। তার মুখে সেই মিষ্টি হাসি। সাবিরও খানিকটা ধাতস্থ যেন। মেনে নিয়েছে, সে সত্যি সৌভাগ্যবান। মা-আব্বার গন্ধ এ জন্মে আবার সে পাবে, কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবেনি।
“তোমরা ভাল আছ তো মা?”
“খুব ভাল আছি রে। তোরা ভাল আছিস যে, তাই। আমাদের মনে করিস। অলক্ষে আমাদের জন্য চোখের পানি ফেলিস। ভুলে যাসনি আমাদের। এতেই বড় শান্তি।”
“প্রতি মুহূর্তে তোমাদের অভাব বোধ করি মা। সারা দিনের জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে একা ঘরে বসে শুধু তোমাদের খুঁজি। কত বার ভেবেছি, এক বার, এক বার যদি আবার ছুঁতে পারতাম তোমায়!”
মা উঠে যায়। হয়তো চোখ মুছতে। সাবিরও চোখ মোছে। মায়ের হাতের রান্না। গরম ভাতে ঘি। লাউশাক পোস্ত দিয়ে, মুগডাল, মৌরলা চচ্চড়ি, টমেটো চাটনি। আহা!
“অনেক রাত হল, শুয়ে পড়।” মায়ের কথা শুনেই হঠাৎ খুব ঘুম পায় সাবিরের। আজ কী শান্তিতে ঘুম আসবে! মায়ের কোলে হারানো শৈশবের মতো করে। চোখের পাতা আর খোলা থাকে না তার।
“স্যর! স্যরজি! হাওড়া স্টেশন আ গয়ে। ন’ মে জাইয়েগা?”
চোখ খুলে মাথাটা ঝিমঝিম করে সাবিরের। বুকের ভিতরটা খুব মোচড় দিয়ে ওঠে। এ সব তবে স্বপ্ন! তা কী করে হয়! মুখে যে এখনও টমেটোর চাটনির স্বাদ, হাতে ঘিয়ের গন্ধ! এত স্পষ্ট, এত ডিটেল স্বপ্ন হতে পারে! না কোনও ভুল নেই। সে নিশ্চয়ই গিয়েছিল তার দেশের বাড়ি। সে ছুঁয়ে এসেছে তার মা-আব্বাকে। বুকের হু-হু ভাবটা কেটে যেতে থাকে। মনটা শান্ত হয়ে আসে। হাওড়া স্টেশনের বাইরের ডিজিটাল ঘড়িতে তখন ঠিক রাত দশটা।
“ভাই, ট্রেন আর পাব না। তুমি দয়া করে যেখান থেকে আনলে ওখানেই ছেড়ে আসবে?”
“জি জরুর। আমি এখন ও দিকেই ফিরব।”
ফেরার পথে মনটা খুশিতে ভরে যায় সাবিরের। এ মিথ্যে নয়। কিছুতেই মিথ্যে নয়। সে সৌভাগ্যবান, তার আব্বা বলেছে! কেউ বিশ্বাস না করে করুক কিন্তু সে জানে, সে সত্যি গিয়েছিল অন্য পৃথিবীতে, মা-আব্বার কাছে। তাদের সুগন্ধ এখনও তার চোখেমুখে। তখনই মোবাইল বেজে ওঠে। ও পারে মারুফা।
“হ্যাঁ গো, ট্রেন পেলে?”
“না ফিরে আসছি। দারোয়ানজিকে বল গেট না লাগাতে।”
“কাল যাবে?”
“যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। বাড়ি আমি আর বেচছি না।”